
হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়া, বাইরে সেলফির হিড়িক: মানবিকতার প্রশ্ন ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ
লেখক: এস এম ফয়েজ
সিনিয়র সাংবাদিক
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। এই গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যেও হাসপাতালের সামনের পরিবেশ ঘিরে দেখা দিয়েছে এক ভিন্ন চিত্র—নেতাকর্মী ও উৎসুক জনতার ভিড় এবং এর মাঝে কিছু মানুষের সেলফি ও ফটোশুট করার প্রবণতা।
হাসপাতালের সামনে ভিড় ও সেলফি সংস্কৃতি
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে সারাদেশ থেকে ছুটে আসছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থক। তাদের আবেগ ও উদ্বেগ স্বাভাবিক হলেও, হাসপাতালের সামনে এই বিশাল জনসমাগম পরিবেশকে বিশৃঙ্খল করে তুলছে।
এই ভিড়ের মধ্যেই লক্ষণীয় একটি প্রবণতা হলো, অনেককে হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে বা আশেপাশে সেলফি এবং ছবি তুলতে দেখা যাচ্ছে।
এছাড়াও প্রতিদিনই আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খবরে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী হাসপাতালের সামনে ভিড় জমাচ্ছেন। এই আবেগপ্রবণ ভিড়ের মাঝে অনেককে দেখা যাচ্ছে হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে বা আশেপাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে এবং ফটোশুট করতে।
এই আচরণ একদিকে যেমন মানবিক সংবেদনশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তেমনি হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রমেও বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। হাসপাতাল একটি সংবেদনশীল ও শান্ত পরিবেশ দাবি করে, যেখানে মুমূর্ষু রোগীরা চিকিৎসা নেন। কিন্তু ভিড় এবং সেলফি তোলার এই প্রবণতা সেই পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে। নানা মহলে সমালোচিতও হচ্ছে।
দলীয় নেতারা বারবার নেতাকর্মীদের ভিড় না করার অনুরোধ জানালেও তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং সরকার খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ বা ভিভিআইপি ঘোষণা করে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) নিরাপত্তা দেওয়া শুরু করেছে।
কেন এই ভিড় ও সেলফি উন্মাদনা?
আবেগ ও কৌতূহল: প্রিয় নেতা, নেত্রী,তারকা বা পরিচিত মুখ অসুস্থ হলে মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে তার খোঁজ নিতে ছুটে আসে। এই ভিড় তাদের উদ্বেগ প্রকাশের মাধ্যম।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব: স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা সেলফি সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করেছে। হাসপাতালের সামনে ভিড়ের মধ্যেও অনেকে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চান।
দৃষ্টি আকর্ষণের প্রবণতা: ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাকে অনেকে নিজেদের “স্ট্যাটাস” বা ঘটনার অংশ হিসেবে মনে করেন, যা এক ধরনের আত্মপ্রদর্শনমূলক আচরণ।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: কেউ কেউ মনে করছেন, এই সেলফি সংস্কৃতি আবেগের চেয়ে আত্মপ্রদর্শন বা সামাজিক মাধ্যমে মনোযোগ আকর্ষণের প্রবণতাকে বেশি উস্কে দিচ্ছে।
স্বীকৃতি ও মনোযোগের আকাঙ্ক্ষা: সেলফি পোস্ট করার মাধ্যমে ব্যক্তিরা অন্যদের কাছ থেকে স্বীকৃতি, লাইক ও কমেন্ট আশা করে। এই মনোযোগ আকর্ষণের আকাঙ্ক্ষা ভিড়ের মাঝেও ছবি তুলতে উৎসাহিত করে।
প্রভাব ও ঝুঁকি:
চিকিৎসা কার্যক্রমে বিঘ্ন: হাসপাতালের প্রবেশপথ ও করিডোরে ভিড়ের কারণে অ্যাম্বুলেন্স চলাচল, জরুরি রোগী আনা-নেওয়া এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি হয়।
নিরাপত্তা ঝুঁকি: ভিড়ের কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয় এবং চুরি বা অন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে।
পরিবেশের পবিত্রতা নষ্ট: হাসপাতাল একটি শান্ত ও পবিত্র স্থান। ভিড় ও ছবি তোলার কোলাহল এই পরিবেশকে নষ্ট করে দেয়, যা অন্য রোগীদের সুস্থতার জন্য ক্ষতিকর।
নৈতিক ও মানবিক প্রশ্ন: একজন মুমূর্ষু মানুষের চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে আনন্দ বা উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
দায়িত্ব ও করণীয়:এই পরিস্থিতি এড়াতে প্রয়োজন জনসচেতনতা এবং দায়িত্বশীল আচরণ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি, যারা ভিড় করছেন তাদেরও বুঝতে হবে যে, তাদের আবেগ যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়।
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম
খালেদা জিয়া কোটি মানুষের আস্থার প্রতীক। তাঁর মতো একজন জাতীয় নেত্রীর অসুস্থতায় মানুষের আবেগ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এই সহমর্মিতা প্রকাশের ধরণ যেন মানবিকতা ও সামাজিক শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন না করে। ভিড় এড়িয়ে চলা এবং হাসপাতালের শান্ত পরিবেশ বজায় রাখা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। সংকটের এই মুহূর্তে দায়িত্বশীল আচরণই কাম্য।









